প্রকাশিত: ১০/১২/২০১৬ ৭:৩৭ এএম

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ও জাবেদ ইকবাল, টেকনাফ::

সেনা বর্বরতার মুখে মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার দল কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকার ঘরে ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে সীমান্তের নাফ নদ ও রোহিঙ্গা শিবির এলাকার কাছাকাছি স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে শত শত রোহিঙ্গা পরিবার।

ইতিমধ্যে কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরে ঢুকে পড়া সদ্য অনুপ্রবেশকারীদের প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে সীমান্তজুড়ে এভাবে স্থানীয়দের আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুরা রয়ে গেছে তালিকার বাইরে।আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে ইতিমধ্যে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে কমপক্ষে ২১ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। বেসরকারি পর্যায়ে এমন হিসাব তুলে ধরা হলেও সরকারের পক্ষে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কাছে অনুপ্রবেশকারীদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বাস্তবে সংখ্যাটা অনেক বেশি হবে, সন্দেহ নেই।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় দালালরা নৌকা নিয়ে মিয়ানমারের ওপারে গিয়ে টাকার বিনিময়ে আনছে রোহিঙ্গাদের। এ দালালরা সবাই টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তের বাসিন্দা। তারা রোহিঙ্গাদের নাফ নদ পারাপার থেকে শুরু করে তাদের আশ্রয়ে অন্তত কয়েক সপ্তাহ রাখার চুক্তি করে থাকে। এ রকম চুক্তির মাধ্যমেই দালালরা রোহিঙ্গাদের নিজেদের আশ্রয়ে রাখছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা কমে গেলে তারা আশ্রয় নেয় পাশের রোহিঙ্গা শিবিরে।

স্থানীয় দালাল ছাড়াও অনুপ্রবেশকারীরা অনেক আগে রাখাইন থেকে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের এপারের ঘরে আশ্রয় নিচ্ছে। নাফ নদের তীরে কয়েক বছর আগে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের বহুসংখ্যক ঘরবাড়ি রয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফের লেদা, মুচনি, জাদিমুরা, পূর্বপাড়া, নাইটংপাড়াসহ অনেক গ্রামের রোহিঙ্গা বস্তিতে সদ্য অনুপ্রবেশকারীদের স্থান হচ্ছে। লেদা পূর্বপাড়ার নজির আহমদের বাড়িতে এক হুকাট্টা (মিয়ানমারের গ্রাম চেয়ারম্যান) আশ্রয় নিয়েছেন। তা ছাড়া লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের রফিক, নূর মোহাম্মদ, নুর হোসেনসহ আরো কয়েকজনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার। একইভাবে হোয়াইক্যং কুতুবদিয়াপাড়ার জামাল হোসেন, আনোয়ারসহ নাফ নদের পাশের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে উঠেছে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার।

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় লোকজনের তথ্য মতে, টেকনাফ বড়ইতলী গ্রামের নুর আলম, তালি ইসলাম, মোহাম্মদ ছিদ্দিক, ইসমাইল, ছৈয়দ নূর, তৈয়ুবা, মোহাম্মদ তৈয়ুবের বাড়িতে সদ্য অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা পরিবার অবস্থান করছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ঝিমংখালী, লম্বাবিল, মিনাবাজার, কুতুবদিয়াপাড়া ও উনছিপ্রাং, হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার, লেদা, জাদিমুরা ও দমদমিয়া এবং কেরুনতলীর বড়ইতলী এলাকা দিয়ে প্রতি রাতেই নাফ নদের ওপার থেকে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে।

সীমান্তের এসব এলাকার আশপাশের বাড়িঘরে আশ্রিত বা ভাড়াটে হিসেবে অবস্থান করছে শত শত রোহিঙ্গা পরিবার। গোপনে অবস্থান করতে গিয়ে অসুখ-বিসুখে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এমনই একজন হলেন মিয়ানমারের শীলখালী (মরিক্ষ্যং) এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন। তিনি গত ১৫ নভেম্বর হোয়াইক্যংয়ের কুতুবদিয়াপাড়ার জামাল হোসেনের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে মারা যান। পরে তাঁকে কুতুবদিয়াপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ মোহাম্মদ হোসেন জানান, কেবল নাফ নদের তীরবর্তী লেদা, জাদিমুরা ও মুচনি গ্রামেই দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা স্থানীয়দের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে।

টেকনাফের হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) শাফায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয়দের বাড়িঘরে রোহিঙ্গা অবস্থানের খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচ-ছয়জন অনুপ্রবেশকারীকে ধরে বিজিবির মাধ্যমে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সতর্ক রয়েছে। খবর পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে। ’

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ নুরুল বসর বলেন, ‘মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার মুখে বিতাড়িত হয়ে নয়াপাড়া শরণার্থী শিবির ও লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পরিবার অবস্থান নিয়েছে। এর বাইরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘরেও শত শত পরিবার অবস্থান করছে। এসব বিষয়ে সরকারের সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। ’

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের কাউন্সিলর নজির আহমদ বলেন, ‘মানবিক কারণে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার স্থানীয় বড়ইতলী গ্রামের কয়েকটা বাড়িতে অবস্থান নিয়েছে সত্য। তবে মিয়ানমারের অবস্থার পরিবর্তন বা বাংলাদেশ সরকার কোনো পরিকল্পনা নিলে সাময়িক আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবারগুলো সেখানে চলে যাবে। ’

নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরেও শত শত সদ্য অনুপ্রবেশকারী : সদ্য অনুপ্রবেশকারী শত শত রোহিঙ্গা বর্তমানে লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের পাশাপাশি নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে। গত মঙ্গলবার নয়াপাড়া শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে হাজার দুয়েক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু অবস্থান করছে। বি-ব্লকের আবু তালেবের বাড়িতে অবস্থান করছেন ওসমান নামের এক নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। আর তাঁর স্ত্রী চার সন্তান নিয়ে রবিবার ভোরে নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরে অবস্থান নিয়েছেন। রোহিঙ্গা ওসমান জানান, এ ক্যাম্পে অন্তত দুই হাজার সদ্য আসা রোহিঙ্গা রয়েছে।

নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিয়ানমারের চলমান নির্যাতনের কারণে কিছু রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প এলাকায় দেখা গেছে। তারা রাতের বেলায় এলেও সকালে চলে যায়। এর পরও কোনো ব্লকের কক্ষে নতুন আসা রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এম এম রেজোয়ান হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প দুটিতে শুধু বৈধ শরণার্থীদেরই থাকার কথা। এখানে অবৈধ লোকজনের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ’

নাফ নদ থেকে দুই বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে বিজিপি : নাফ নদে মাছ ধরার সময় দুই বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। বুধবার ভোরে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের লম্বাবিল সীমান্ত বরাবর নাফ নদ থেকে তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরা হলেন লম্বাবিল গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে নাজির হোসেন ভুলু ও সৈয়দ আলীর ছেলে আব্দু শুক্কুর।

বিজিবির উনচিপ্রাং ক্যাম্প কমান্ডার এনায়েত হোসেন ও ঝিমংখালী ক্যাম্প কমান্ডার রাকিবুল হাসান এলাকাবাসীর কাছ থেকে বিষয়টি শুনেছেন বলে জানান।

রোহিঙ্গাবাহী আরো ৯টি নৌকা ফেরত : নাফ নদ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুবোঝাই আরো ৯টি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত নাফ নদের পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে এসব নৌকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

টেকনাফে বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, ফেরত পাঠানো নৌকাগুলোতে শতাধিক রোহিঙ্গা ছিল।

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু, দৈনিক উৎপাদন ৩০ মেগাওয়াট

কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদীর খুরুশকুল উপকূলে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছেছবি: প্রথম আলো কক্সবাজার সদর উপজেলার ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং!

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলছে ‘টার্গেট কিলিং’। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ...

জান্নাতুলকে খুনের কথা আদালতে স্বীকার করলেন কক্সবাজারের রেজা

রাজধানীর পান্থপথে আবাসিক হোটেলে চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিকা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ...

খাদ্য সংকটে সেন্টমার্টিন

হেলাল উদ্দিন সাগর :: বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ...